বিআরটিএর অনিয়ম দুর্নীতির সরেজমিন প্রতিবেদন

বিআরটিএর দুর্নীতির সম্রাট সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনসারী পর্ব-১

Passenger Voice    |    ০৪:১৬ পিএম, ২০২০-১২-০৩


বিআরটিএর দুর্নীতির সম্রাট সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনসারী পর্ব-১

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর কেরানীগঞ্জ ইকুরিয়া অফিসে গাড়ি নিবন্ধনের সরকারী কর ও ফির ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৪৩ হাজার ৬০০ টাকা সরকারী কোষাগাড়ে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছিল বিআরটিএর তৎকালিন ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মো. মজিবুর রহমান, সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) সহিদুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মো. আমিনুল হক সরকার, মোটরযান পরিদর্শক শেখ মো. সেলিম, পুলিশ পরিদর্শক সুলতান আহমেদ, উচ্চমান সহকারী মো. নুরুল ইসলাম, কারিগরি সহকারী মো. আইয়ুব আনসারী, মো. কামরুজ্জামান, মো. আবুল হাসান ও এ বি.এম ছালেকুজ্জামান। পরবর্তীতে সরকারের রাজস্ব চুরির এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে এই সার্কেল থেকে ১ হাজার ৬৪৩ টি গাড়ির নথিপত্র উধাও করে দেয় এই কর্মকর্তারা। অভিযুক্ত কতিপয় দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তাদের হাত ধরে বিআরটিএ দুর্নীতি শুরু করা সেই কারিগরি সহকারী মো. আইয়ুব আনসারী ১৬ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে বরিশাল বিভাগের আলোচিত বিআরটিএর দুর্নীতির সম্রাট সহকারী পরিচালক হয়েছেন তিনি। বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার ডেবরা গ্রামের পশ্চিম কাউনিয়া সাধুর বটতলা এলাকার মৃত আতাহার আলী হাওলাদরের ছেলে আইয়ুব আনসারী এক সময় বিআরটিএর ভয়ঙ্কর দালাল ছিলেন । পরে বিআরটিএর কারিগরি সহকারী হিসেবে বিআরটিএতে যোগদান করা ২০১১ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারী অস্থায়ী ভাবে বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক এর দায়িত্বপান তিনি। 

বিআরটিএ নিজেই দফায় দফায় এই কর্মকতার অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত করে দুর্নীতির সত্যতা পায়। আইয়ুব আনসারীদের মতো বিআরটিএর ১২টি কার্যালয়ে কমপক্ষে ২৪ জন কর্মকর্তা ভুয়া নথিপত্রে জাল করে গাড়ির নিবন্ধন করেছেন বলে বিআরটিএর একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছেন। 

গুরুদের শিখানো গাড়ি নিবন্ধনের সরকারী কর ও ফির আত্মসাৎ করার দুর্নীতি হাতে কলমে চর্চা শুরু করে ২০১১ সালে। সেই সময়ে তিনি ছিলেন বরিশাল বিভাগের ভোলা সার্কেলের দায়িত্বে। এত দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরেও তাকে সহকারী পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় বিআরটিএ প্রশাসন। এইসময় ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির মাধ্যমে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় আনা বিক্রয়নিষিদ্ধ রেঞ্জ রোভার মডেলের গাড়ি নিবন্ধন দেয় এই আইয়ুব আনসারী। এই গাড়িটি ২০১০ সালের ১২ মার্চ ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ফরিদ নাবির নামের এক ব্যক্তি বাংলাদেশে আনেন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বিল অব এন্ট্রি-১০৪৫৯১১, তারিখ ১৩/১২/২০১১-এ ১৩০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ভোলা বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন করা হয়। ভোলা-ঘ-১১-০০৩৫ নং নিবন্ধিত এই গাড়িটির মালিক দেশের আলোচিত মুসা বিন শমসের।  

ভোলা সার্কেলে আইয়ুব আনসারীর আমলে দুর্নীতি ও রোহিঙ্গাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানঃ

‘ঘুষ খাইলে কী হয়, জেল হয়, ফাঁসি তো আর হয় না’। এ মন্তব্য ছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক কর্মকর্তার। এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দেদারসে দুর্নীতি চালিয়ে যায় বিআরটিএ ভোলা সার্কেলে। এতে ভাবমুর্তির ক্ষতি হয়েছে সরকারের, এখনও ভুগছেন সেবা প্রার্থীরা। তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিলনা দুর্নীতিবাজ এই আইয়ুব আনসারীর। “মামু টাহা আনছ, টাহা আনলে কাম অইবে, না আনলে অইবে না, আনলে ফিঙ্গার দাও” এমন উক্তিদিয়ে গণহারে ড্রাইভিং পরীক্ষা না নিয়ে, ভুয়া জাল ভলিয়ম ও জাল বোর্ড রেজুলেশন তৈরি করে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করেছিল এই কর্মকর্তা।  এইসব ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে প্রায় ১০ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছিল। তবে এখানে শেষ নয় চট্টগ্রাম জেলা সাতকানিয়া ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও চট্টগ্রাম নগরীর ভুয়া জাতীয় নাগরিক সনদপত্র ব্যবহার করে প্রায় ২ হাজার রোহিঙ্গাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করেছে। যারা পরবর্তীতে এই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে বিআরটিএতে মুখে মুখে ঘুরপাক খেলেও কোন কর্মকর্তা তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেননি। 

এছাড়াও এই সার্কেলে কয়েকশত ভুয়া ও জাল কাগজে ড্রাম ট্রাক ও পিকআপের নিবন্ধন দেয় এই কর্মকর্তা। এই সময় এই সার্কেলে মোটরযান পরিদর্শক ও সহকারী পরিচালক দুই দায়িত্বে ছিল আইয়ুব আনসারী। 

বরিশাল সার্কেলে চুরি হওয়া গাড়ি নিবন্ধন দিয়ে বর্তমানে কারাগারে আইয়ুব আনসারীঃ

২০১১ সালের ২৩ মার্চ মাদারীপুর জেলার মশিউর রহমান ঠাকুরের ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-৩১৫০) গাড়িটি মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানা এলাকা থেকে চুরি হয়। এ ঘটনায় একই দিন গাড়ির চালক শাহজাদা শিকদার শিবালয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পরবর্তীতে একই চেসিস নম্বরে ১টি মাইক্রোবাস বরিশাল বিআরটিএ অফিসে নতুন রেজিস্ট্রেশন (বরিশাল ছ-১১-০০৩৯) দেয়। আইয়ুব আনসারী তখন এই সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক ছিলেন। তার নিজ স্বাক্ষেও বরিশাল ছ-১১-০০৩৯ নং গাড়ির মালিক রূপ কুমার বিশ্বাসের দাখিলকৃত কাগজপত্র সঠিক ও ত্রুটিমুক্ত উল্লেখ করে সনদ প্রদান করেন। তার সুপারিশের ভিত্তিতে তৎকালীন সহকারি পরিচালক নূরুজ্জামান চোরাই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন প্রদান করেন। পরে এই ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ালে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর এই মোটরযান পরিদর্শক আইয়ুব আনসারীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন বরিশাল বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মো. মহিসন উল হক। এভাবে অনিয়ম করতো এই সার্কেলে।

আরো পড়ুন >>>>>>>>>>>> বিআরটিএর সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনসারী গ্রেফতার 

ঝালকাঠি সার্কেলে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আনসারীর দুর্নীতিঃ

২০১৯ সালের ৪ জুলাই ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে কক্সবাজার জেলার দুই ব্যক্তিকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে এনডিসি ও ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ বসির গাজী। উক্ত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে কক্সবাজার জেলা থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য ঝালকাঠি বিআরটিএ অফিসে এসেছেন জানালে এনডিসির সন্দেহ হয়। সন্দেহের তীর যায় বিআরটিএর দিকে। বিষয়টি জেলা প্রশাসক মোঃ জোহর আলীকে অবহিত করে বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ১১ গ্রাহক ও ২ দালালকে আটক করেন তিনি। তারা প্রত্যেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে আইয়ুব আনসারীর অফিসে যায় ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে। ভ্রাম্যমান আদালতের ১৩ জনকে সাজা দিলেও দুর্নীতির বড়পুত্র আইয়ুব আনসারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএ প্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়। এই সার্কেলে অবৈধ ভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করে প্রায় ৬ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। 

এই অভিযোগের পরেও এই সার্কেলে ঝালকাঠি-ড-১১-০০২২, ঝালকাঠি-ন-১১-০২৩২, ঝালকাঠি-ড-১১-০১২৫ নম্বর গাড়ি সহ ১২ টি চট্টগ্রামের স্থানীয় গ্যারেজে তৈরী করা গাড়িকে নিবন্ধন দেয় আইয়ুব আনসারী। এই সময়ে এই সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক ছিলেন মাহফুজ হোসেন খান।